হাঁটাহাঁটি আমাদের জ্ঞানানুসন্ধানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হাঁটতে হাঁটতেই আমরা বেশি জানতে পারি। আর এটাই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন এবং কার্যকর জ্ঞানানুসন্ধান পদ্ধতি। ট্রেনে বা বাসে এমনকি বিমানে করে আমরা জ্ঞানানুসন্ধান করতে পারি; বিমানের জানালা দিয়ে একটু আয়েশী উঁকি দিয়ে, ট্রেনের জানালা দিয়ে গ্রাম, গাছ-পালা ও ছোট ছোট(!) মানুষগুলোর দ্রুত হারিয়ে যাওয়া দেখে কিংবা বাসের জানালায় একটু আলস্য ভরা দৃষ্টিতে জীবন ও জীবনের বয়ে চলার দিকে একটু উকি দিয়ে দেখাতেও অশেষ জ্ঞানলাভ হতে পারে। কিন্তু কোন একটা জায়গাকে পাঠ, ওখানকার জীবনকে অধ্যয়ন, ইতিহাসকে জানা এবং এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে গভীর জ্ঞান অর্জনের জন্য হাঁটাহাঁটির বিকল্প নেই। এজন্য এখনো কোন প্রজেক্ট কার্যকর করা, কোন এক বিশেষ জনগোষ্ঠীকে স্টাডি করা বা কোন বিষয়ে গভীর জ্ঞানানুসন্ধানের জন্য "ফিল্ডওয়ার্ক" নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যুক্ত আছে আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতির সাথে।
আগেকার দিনের মুনী, ঋষী,সাধু-সন্তু, পণ্ডিতজনেরা হেঁটেছেন অনেক।
এখনকার বিজ্ঞজন, পণ্ডিতজনেরাও তো কম ঘুরেননা, কম হাঁটেননা! হাঁটাহাঁটির সাথে খুজে দেখা, অবলোকন করা, গভীর অনুসন্ধান উতপ্রোতভাবে জড়িত। যাদের জ্ঞানানুসন্ধানে হাঁটাহাঁটি বা ‘হন্টনকর্ম’ যুক্ত নয় তাদের তথ্য ও তত্ত্ব বিশ্বাসযোগ্য নাও হতে পারে, ভুল হতে পারে, অকার্যকর হতে পারে! “আরাম কেদারার” পণ্ডিতের সংখ্যা দেশে অভাব নেই। এখন ধূলাবালি মাখা পণ্ডিতও দরকার। আজকের পৃথিবীতে যারা পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিচ্ছে তাদের মধ্যে এমন শ্রমিক শ্রেণীর পণ্ডিতদের কঠোর শ্রমের উপরই দাড়িয়ে আছে তাদের ক্ষমতার ইমারত। আমরা বিশ্বকে কি দিতে পারি তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমরা আমাদের দেশকে কি দিচ্ছি। এজন্য ঘরে বসে থেকে বই-পুস্তক কপ্চাইলেই হবেনা। বইকে চেখে দেখতে হবে জীবন্ত বইয়ের সাথে। এক একটা জায়গা এবং তাদের জনগোষ্ঠী এক একটা জীবন্ত বই। প্রত্যেকটা জায়গা তার বই খুলে রেখেছে,তাদের ইতিহাস গুনগুন করে বলছে। আমাদেরকে ঐসব জীবন্ত বই পাঠ করতে তাদের কাছে চলে যেতে হবে, তাদের ইতিহাসের গুনগুনানি শুনতে হবে। জীবন্ত বইয়ের সাথে মিলিয়ে দেখতে হবে মৃত পৃষ্ঠাওয়ালা গ্রন্থপুঞ্জিগুলোকে!
এজন্য ঢাকা ইউনিভার্সিটি রিডিং ক্লাবের একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড হচ্ছে ‘নলেজ ওয়াক’। আমরা গত বছর সোনারগাঁ ও পানাম নগর গিয়েছিলাম আমাদের নলেজ ওয়াকে। সোনারগাঁর ইতিহাস, ঐতিহ্য আর গল্পগাথা মেলে ধরেছিলেন আমাদের নলেজ ওয়াকার লেখক শামসুজ্জোহা চৌধুরী, বাংলার শিক্ষক মোহাম্মদ আলাউদ্দিন ও ইতিহাসের ছাত্র ম্যাক্স সজীব।
২০১৪ এ আমরা গিয়েছি দেশের একটি সেরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই শীতে তার সৌন্দর্যের ঢালি খুলে রাখে যেন এই অনন্য ক্যাম্পাসটি। আমরা দেখেছি প্রকৃতি, পাখি, গাছ, পদ্ম, জল আর যা আছে সব! আর বিশ্ববিদ্যালয়টির বিভিন্ন একাডেমিক ভবন, অনুষদ, বিভাগ তার কৃতী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সাথে পরিচিত হওয়া,তাদের ইতিহাস এবং জাতীয় জীবনে ঐসব বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভূমিকা নিয়ে জানার চেষ্টা তো ছিলই। আর একেবারে নীরব হয়ে দীর্ঘক্ষণ হাঁটার অভিজ্ঞতা মনে রাখার মত। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মাঝে মাঝে সংক্ষিপ্ত লেকচার যা আমাদের জানার পরিধি বাড়িয়ে দিয়েছে এ কথা বলা যায় নির্দ্বিধায়। সাপের মত আকারের বিভিন্ন জলাধারের পাশে দুর্বাঘাসে বসে গান ও কবিতা আবৃত্তি শোনা এবং বিভিন্ন জনের অনুভূতি শোনা অনেক বড় অভিজ্ঞতা ছিল।
মাঝখানে আমরা গণবিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে আসলাম, মনসুর মুসার সাথে আলাপ করলাম এবং সেখানকার একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করলাম।
শেষ বিকালে জাতীয় স্মৃতি সৌধের কাছে গিয়ে আমাদের মন শ্রদ্ধায় ভরে গেল বাংলাদেশ নির্মাণে অজস্ত্র শহীদের ত্যাগের কথা মনে করে। স্মৃতি সৌধের সামনে বসে আমরা কবিতা আবৃত্তি ও বিভিন্ন জনের অনুভূতির কথা শুনলাম। সবশেষে সেখান থেকে যখন ফিরে আসছিলাম তখন রিডিং ক্লাবের ব্যানার সামনে রেখে মৌন মিছিল করে ফিরছিলাম।
আমাদের মন ও মনন প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় হয়েছিল, সংকল্পে অনঢ় হয়েছিল একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের প্রত্যয়ে।
আরেকটি নলেজ ওয়াকের কথা ভেবে ভেবে দিনটি শেষ হয়েছিল। অপেক্ষা করছি এমন আরেকটি দিনের অপেক্ষায়।
সাবিদিন ইব্রাহিম
০৭.০২.২০১৪
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন