‘মানুষ আছে, দেবতা আছে আর আছে পিথাগোরাসের মত কিছু।’ নিজের সম্পর্কে এমন অদ্ভূত ধারণা পোষণ করতেন পিথাগোরাস। পিথাগোরাস একই সাথে আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব আবার একই সাথে দার্শনিক, জীবন দর্শন প্রণেতা। তার নামে, তার দর্শনের অনুসারী একটি বিশেষ সম্প্রদায় অনেক দিন ধরে কাজ করে গিয়েছিল। পিথাগোরাস ও তার অনুসারীদের অদ্ভূত জীবনাদর্শ বর্তমানে আমাদের হাসির উদ্রেক করলেও তাদের সময়ে যথেষ্ঠ প্রভাব বিস্তার করেছিল। পিথাগোরাসের জীবন দর্শন অনেক অদ্ভূত মনে হওয়ার যথেষ্ঠ কারণ আছে।
বার্ট্রান্ড রাসেলের ‘হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলসফি’তে এমন ১৫টি রীতি নীতির কথা বলেছেন(পৃষ্ঠা ৫১, ‘হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলসফি’)। তার মধ্যে মাত্র কয়েকটির কথা বলি:
১. যে জিনিস পড়ে গেছে এটা তুলবেনা।
২. সাদা মোরগ ছুঁয়োনা।
৩. রুটি ভাঙোনা।
৪. লোহা দিয়ে আগুন নাড়িওনা।
৫. গাঁদা ফুল ছিড়োনা।
৬. কলিজা খেয়োনা।
৭. মহাসড়কে হেঁটোনা।
৮. তোমার বাসার ছাঁদে চড়াইকে বসতে দিয়োনা।
৯. আলোকে পাশে রেখে কখনো আয়নার দিকে তাকিওনা।
১০. বিছানা থেকে উঠে বিছানা ঘুটিয়ে রাখবে এবং সেখানে শরীরের ছাপ রাখবেনা।
এমনতর বিচিত্র রীতিনীতি মেনে চলতো পিথাগোরাসের অনুসারীরা!
পিথাগোরাসের মতে আত্মা হচ্ছে অমর এবং এটা বিভিন্ন রূপ ধারণ করে। যা কিছুই জন্ম গ্রহণ করে সেগুলো বারবার ফিরে আসে বিভিন্ন রূপে। এজন্য যা কিছুর জীবন আছে তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে। পিথাগোরাস নিয়ে আরেকটি মিথ প্রচলিত তিনি সেইন্ট ফ্রান্সিসের মতো জীব জন্তুর কাছে প্রচার করতেন। (পৃষ্ঠা ৫২, হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলসফি’)
কয়েকটি ক্ষেত্রে পিথাগোরাস তার সময়ের চেয়ে কয়েক সহস্রাব্দ এগিয়ে ছিলেন। যেমন নারী পুরুষের সমতা। তিনি মনে করতেন তারা সমান, সম্পদের সমান অংশীদার এবং তারা একই ধরণের জীবন ধারণ করতে পারে।
পিথাগোরাসের আরেকটি বিখ্যাত তত্ত্ব হচ্ছে, ‘সবকিছুই সংখ্যা’। তিনি সংগীতে সংখ্যার গুরুত্ব আবিষ্কার করেছিলেন। বর্গ ও ঘনের ধারণা আমরা পিথাগোরাস থেকেই পাই। সংগীত নিয়ে তাদের আরেকটি শক্ত মত হচ্ছে এর রোগ সাড়ানোর ক্ষমতা আছে যেটা আসলে অনেক সুদূরপ্রসারী চিন্তা ছিল। সংগীত তাদের দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দাড়িয়েছিল কারণ এর মাধ্যমে প্রমাণ করা অতি সহজ ছিল যে ‘সবকিছুই সংখ্যা’।
অ্যারিস্টটলের মতে ‘পিথাগোরিয়ানরা নিজেদেরকে গণিতে আত্মনিমগ্ন করেছিল। জ্ঞানের এই ক্ষেত্রটির উন্নয়নে তারাই প্রথম কাজ করে।’(পৃষ্ঠা ৯, সক্রেটিস টু সার্তে, স্যামুয়েল ইনুচ স্টাম্ফ)
গণিত চর্চা আত্মার সর্বোত্তম শুদ্ধকারী হিসেবে মনে করতেন পিথাগোরাস। তিনি একই সাথে একটি ধর্মীয় গোষ্ঠি আবার একটি গণিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে স্বীকৃত।
হোমারীয় দেব-দেবীদের নিয়ে রয়েছে তাদের সমালোচনা। তারা মনে করতো ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে হোমারের দেব-দেবীরা পূজনীয় হতে পারে না। কারণ তারা মানুষের মতই পাপ তাপে নিমজ্জিত। এমন কোন বস্তু মানুষের প্রার্থনার বিষয় হতে পারে না। এবং তারা কোন আধ্যাত্মিক শক্তিরও উৎসও নয়। (পৃষ্ঠা ১০, সক্রেটিস টু সার্তে, স্যামুয়েল ইনুচ স্টাম্ফ)
পিথাগোরাস এবং তার অনুসারী পিথাগোরিয়ানদের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব পরবর্তী দার্শনিকদের উপর তাদের প্রভাব। বিশেষ করে প্লেটোর উপর তাদের প্রভাব বিশাল। পুরো পাশ্চাত্য দুনিয়ার দর্শনকে যে ব্যক্তির দর্শনের ‘ফুটনোট’ বলা হয় তিনি সক্রেটিসের পরে আর যার দ্বারা সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছেন সেটা অবশ্যই পিথাগোরাস।